girl-teenager

এসএসসির ফলাফলে নাটকীয় পতন

এসএসসির ফলাফলে নাটকীয় পতন

বাংলাদেশে মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষার ফলাফল শুধু শিক্ষাব্যবস্থার মানের প্রতিফলন করে না, বরং এটি সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি ক্ষুদ্র কাঁচি হিসেবে কাজ করে। তাই যখন ফলাফলে নাটকীয় পতন ঘটে, তা শুধুমাত্র শিক্ষাগত বিষয় নয়—এটি জাতীয়ভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। তথ্যমতে, চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার পাস করেছেন ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী; যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। অন্যদিকে, ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন; যা গত বছরের চেয়ে কমেছেন ৪৩ হাজার ৯৭ জন। গত বছর পাস করেছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।

এই ড্রপ গভীরভাবে বিশ্লেষণে আহ্বান জানাচ্ছে—কারণ কী, কীভাবে, কতটা ক্ষতিকর ও সমাধান?

পতনের মাত্রা——

১. ফলাফলে ফলিত পরিমাণ ও মাত্রা
   – সর্বশেষ ফলাফলে এসএসসি পরীক্ষার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে ১,৩৯,০৩২ জন (২০২৫ সালে) হয়েছে
   – ২০২৪ সালের তুলনায় মোট পাসের হার প্রায় ১৪–১৫ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে
   – রাজশাহী বোর্ড সেরা (৭৭.৬৩%), বরিশাল বোর্ড সবচেয়ে খারাপ (৫৬.৩৮%)

২. বোর্ড ও বিভাগের বরাদ্দ
   – ঢাকা বোর্ডের ফল ৬৭.৫১%
   – মাদ্রাসা ও টেকনিক্যাল বোর্ডের ফল যথাক্রমে ৬৮.০৯% ও ৭৩.৬৩% Prothomalo+5bdnews24.com+5bdnews24.com+5
   – হাতে থাকা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় বিভাগে তুলনামূলক উন্নতি হলেও মানবিক বিভাগের ফল খুব খারাপ (বরিশালে মাত্র ৪৩%)


পতনের মূল কারণ

১. কঠোর মূল্যায়ন ও গ্রেস মার্কস প্রত্যাহারের পরিবর্তন

নতুন বছর থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ‘grace marks’ বাতিল, সাধারিত অতিরিক্ত নম্বর প্রদান বন্ধ ও বিস্তারিত মূল্যায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষকরা নম্বর দিতে উৎসাহী হননি । ঢাকার IER-এর ড. রশীদ ও প্রফেসর হাফিজুর রহমান জানান, পূর্ববর্তী সরকার ফলাফল উন্নত করে জনসন্তুষ্টি সংগ্রহ করতো, এবারে তা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়েছে

২. শিক্ষা-সংযোগহীন ও হঠাৎ পরিবর্তন

পাঠ্যপুস্তক, মূল্যায়ন ধরনের বহুল পরিবর্তনের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা স্থিতিশীলতা হারিয়েছে; যেটি দীর্ঘকাল ধরে ফলাফলে ওঠা-পড়া সৃষ্টি করছে

৩. অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা

– ২০২৪ সালের “জুলাই শিক্ষার্থী আন্দোলন”–এর সময় শ্রেণিকক্ষে অবস্থা ব্যাহত হওয়ায় পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটেছে; সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যানও এটিই পতনের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত
– এলাকা বিশেষে অবরুধ, বন্যা ও কোভিড–১৯ প্রভাব পড়ার কারণ ফলাফলে দরদরীয়া পার্থক্য তৈরি করেছে

৪. শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত ঘাটতি

সিলেট ও গ্রামীণ বোর্ডে শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল; প্রতি শিক্ষক বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী; অর্থনৈতিক দরিদ্রতা ও অভিভাবকদের অদক্ষতা পাঠপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে


ফলাফলের প্রভাব

১. শিক্ষাব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস

প্রচণ্ড ওঠা-পড়ার কারণে শিক্ষার্থীদের ও অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অবিশ্বাস বেড়েছে

২. কোচিং–ভিত্তি শিক্ষা ব্যতীত

‘creative questions’–এর কারণেই শিক্ষার্থীরা গাইডবুক ও কোচিংতে নির্ভর করছে, যা মৌলিক শিক্ষার স্থায়িত্ব নষ্ট করছে

৩. অঞ্চলের বৈষম্য প্রকট

সিলেট–বরিশাল–সুন্দরগঞ্জ এলাকায়, যেখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও বন্যা-জুলাই–বিব্রত বাধা, ফলাফলে যথোপযুক্ত উন্নতি হয়নি

৪. উৎকণ্ঠা ও মানসিক প্রভাব

চাপ ও ফলাফলের ভয়, পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়িয়েছে; পাশাপাশি ফলাফলের গুরুত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে সঠিক মূল্যায়নের থেকেও ফলাফলে GPA বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।


 সুপারিশ

১. মানসম্মত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন:
সরকার ও বোর্ডগুলোকে অবশ্যই ‘creative question’ পদ্ধতি ও সৃজনশীল মূল্যায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

২. স্থির ও কাঠামোপ্রসূত পরীক্ষার রেগুলেশন:
পাঠ্যপুস্তক ও পড়া–লেখার নিয়মাবলী হঠাৎ পরিবর্তনের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণাভিত্তিক ও ধাপে ধাপে পরিবর্তনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা উচিত

৩. প্রশিক্ষণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ:
শিক্ষক সংকটে ভুগা অঞ্চলগুলোতে শিক্ষকের নিয়মিত নিয়োগ ও পর্যায়ক্রমে পর্যালোচনার মনিটরিং জরুরি।

৪. সহজ নয়, যথার্থতা মূলমন্ত্র:
গুপ্ত নম্বর প্রদান ও শিক্ষার্থীদের GPA–তে সাজানো ফলাফল না করে প্রাপ্য নম্বর দেয়ার নীতিতে ফিরে আসা দরকার।

৫. অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ পদক্ষেপ:
সিলেট, সুনামগঞ্জ, বরিশাল অঞ্চলে বিদ্যালয় পুনর্গঠন, শিক্ষকের উপস্থিতি নিশ্চিত ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফলাফলে ধারাবাহিক উন্নতি আনা সম্ভব।

  1. বন্যা ও অস্থির পরিস্থিতিতে শিক্ষা সহায়ক ব্যবস্থা:
    প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক পরিবারের কারণে নির্দিষ্ট অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিলে দ্রুত অতিরিক্ত ক্লাস, অনলাইন লিংকিং ও চোখে পড়ার ব্যবস্থা নেওয়া।

  2. শিক্ষার পাশের দক্ষতা:
    শ্রেণিকক্ষের বাইরে “competency-based” শিক্ষা কার্যক্রম, যেমন প্রকল্প ভিত্তিক পাড়া–স্কুল, লাইব্রেরি কাজ, বিজ্ঞান প্রকল্প ও শিল্প-কলা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা।

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে নাটকীয় পতন শুধু পরিসংখ্যা নয়; এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ঘাটতি, অব্যবস্থা ও সম্ভবপর পরিবর্তনের আহ্বান। বলতে পারি, “নিম্ন ফলাফলের পেছনে একটি ধর্মঘট কিংবা গণ আন্দোলন নয়, বরং জনমতের এই ধরনের ফাটল এক নতুন পর্যালোচনার কথা বলছে”।

শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন সহযোগে পঠনপাঠন, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যে আস্থা প্রতিষ্ঠা করা নাগরিক ও আগামী প্রজন্মের দায়িত্ব।

—– জনৈক শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *